স্টাফ রিপোর্ট।
সরকারি জায়গা ও টাকায় নির্মিত ২৭০টি ফ্ল্যাট পছন্দের আমলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামে বেআইনিভাবে বরাদ্দ দিয়ে গেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে চিহ্নিত এসব আমলা ও শিক্ষককে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ দেন। তাদের মধ্যে সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিব, উপসচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকও আছেন। তালিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পলাতক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমানের নামও আছে।
আটক সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গোপন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিয়ে বিনামূল্যে একাধিক ফ্ল্যাট নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া রয়েছে জমি, প্লট, শেয়ার, ব্যাংকে জমানো টাকাসহ অন্যান্য সম্পদ। অর্থ পাচার করে কানাডার টরন্টো শহরে বাড়ির মালিক হয়েছেন।
দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে দেশে-বিদেশে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবু আলম শহীদ খান স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় রাজধানীর ইস্কাটনের বোরাক টাওয়ার থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এই টাওয়ারে তাঁর নামে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের মূল্য তিনি পরিশোধ করেননি। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে উপার্জনশীল কোন কর্মে যুক্ত না থাকলেও তাদের নামে বিপুল সম্পদ রয়েছে। আবু আলম দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে রখেছেন।
সচিবদের পেটেও উচ্ছেদকৃতদের ফ্ল্যাট
ফ্ল্যাট বরাদ্দসংক্রান্ত কমিটির প্রথম বোর্ড সভায় ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পিআরএলে যাওয়া সচিব আবদুল জলিল বরাদ্দ পান পদ্মা-৫/ডি নম্বরের ফ্ল্যাটটি। এর আগে তিনি রাজউকের উত্তরা প্রকল্পে ৩ কাঠার প্লট ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে সিলেট শাহজালাল হাউজিং এস্টেটে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বরাদ্দ পান পদ্মা-৬/ডি ফ্ল্যাটটি। এর আগে তিনি রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্প থেকে পাঁচ কাঠার আরেকটি প্লট বরাদ্দ নেন। বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বরাদ্দ নেন পদ্মা-৭সি নম্বরের ফ্ল্যাট। এর আগে তিনিও রাজউক থেকে সাড়ে সাত কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ নেন। লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক বরাদ্দ নেন পদ্মা-৪/এ ফ্ল্যাট। তার নামেও রাজউকের পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট আছে। পরিকল্পনা কমিশনের সচিব জুয়েনা আজিজ বরাদ্দ নিয়েছেন পদ্মা-৬/এ নম্বরের প্লটটি। সচিবদের মধ্যে আরো যারা এ প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সেতু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সেলিম রেজা, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন আল রশীদ, বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব হাবিবুর রহমান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব হোসেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সচিব শরিফা খান, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মনজুর হোসেন, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সাবেক সচিব মইনুল কবির, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. হুমায়ুন কবীর, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক সচিব এবিএম। য়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও সাবেক অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। তার ফ্ল্যাট নম্বর পদ্মা-৭ডি। তিনি এর আগে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প থেকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট নিজের নামে বরাদ্দ নেন।
২০২৪ সালের ডামি ভোটের কারিগর সাবেক নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বরাদ্দ নেন মেঘনা-১১/এ নম্বরের ফ্ল্যাট। এর আগে তিনি রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প থেকে তিন কাঠার একটি প্লট ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ধানমন্ডি প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি অভিজাত ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেন। সেতু কর্তৃপক্ষের ফ্ল্যাটটি বরাদ্দ নেওয়ার সময় তিনি ওই তথ্য গোপন রাখেন বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, আবদুর রউফ তালুকদার কিংবা আনিছুর রহমানের আত্মীয়স্বজন এমনকি দূর সম্পর্কেরও কারো নাম নেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায়।
ওবায়দুল কাদেরের সাবেক পিএস মোহাম্মদ শফিকুল করিম, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম সচিব কামরুল হাসান খান, মির্জা তারিক হিকমত ও জাকির হোসেন, উপসচিব ড. আমিনুল ইসলাম, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের মহাপরিচালক ড. মশিউর রহমান, উপপ্রধান মাহবুবের রহমান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শেখ শোয়েবুল আলম ও শাহানারা খাতুন, পূর্ত ও উন্নয়নের যুগ্ম সচিব আবদুর রউফ, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলাম খান, অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আরফিন আরা বেগম, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মজুমদার। তারা ওবায়দুল কাদেরের বিশেষ কোটায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান।
প্রকৌশলীদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দের হিড়িক
সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে ২০১৯ সালের ১৭ জুনের ফ্ল্যাট ব্যবস্থাপনা ও বরাদ্দ প্রদান কমিটির বৈঠকে যেসব কর্মকর্তা ভাগ পান তাদের মধ্যে আছেন সংস্থার উপসহকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহম্মেদ, উপসহকারী প্রকৌশলী রাজন চন্দ্র বিশ্বাস, উপসহকারী প্রকৌশলী তাসলিমা খাতুন, উপসহকারী প্রকৌশলী শেখ ফরিদ, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহীন, উপসহকারী প্রকৌশলী আলিফ হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম, উপসহকারী প্রকৌশলী আফরোজা পারভীন, উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুর রহমান।
এছাড়া ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের উপপরিচালক আবদুর রহমান তরফদার ও নির্বাহী প্রকৌশলী এআর খায়রুজ্জামান, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের, সহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ ও সফিকুল ইসলাম চৌধুরীসহ ১৩ কর্মকর্তার নামে ওই প্রকল্পের অধীনে নির্মিত কর্ণফুলী নামের বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর ২৪ অক্টোবরের বৈঠকে সেতু কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক সাব্বির আহমেদ, প্রটোকল অফিসার মাসুদ রানা শিকদার, সহকারী প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত রুবেল ও সৈয়দ রিয়াজ উদ্দিন, সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম ও কম্পিউটার অপারেটর অসীম কুমার পদ্মা ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান।