স্টাফ রিপোর্ট।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করা হলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হতো। মূলত গুমকারী সংস্থার নির্যাতনের কারণে এ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হতেন ভুক্তভোগীরা। আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করতে বিচারকদের সঙ্গে গুমকারী সংস্থাগুলোর যোগসাজশও ছিল। ভুক্তভোগীদের তুলে নিয়ে পেটানোর সময় হিন্দি গান বাজানো হতো। দীর্ঘদিন বন্দি রেখে নৃশংস নির্যাতনের ফলে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন। আতঙ্কে ঘুমাতে পারেন না। জোর করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তির ফলে গুম হওয়ার পর ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার একজন ভুক্তভোগী তদন্ত কমিশনকে বলেন, তখন নির্বাচনের আগ মুহূর্ত। আদালতে পুলিশকে আমি বলছি, আমারে মাইরা ফেললেও ১৬৪ দেব না। ওদের একজন আইসা (বিচারককে) বলতেছে ১৬৪ দিতে চায় না, অনেক চেষ্টা করছি। তখন জজ বলে ও এখনও দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে। ১৬৪ দেয় না, এটা তো এখনও দাঁড়িয়ে আছে, সুস্থ আছে। ১৬৪ দেওয়ানোর জন্য কিছু মসলা বের করতে হবে, না?
বিচারক ও গুমকারীদের যোগসাজশে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি আদায়ের বিষয়ে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলো আংশিক সত্য বা অর্ধ সত্য হলেও, সেগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের গুরুতর কর্তব্যে অবহেলা প্রকাশ করে। আইনজীবী ও বিচারকদের উপযুক্ত তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার আওতায় আনা উচিত। যদি তাদের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জোরপূর্বক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনায় ৫ আগস্টের পরও ভুগতে হচ্ছে বলে গুম কমিশনকে জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী। একজন ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, পটপরিবর্তনের পর পাঁচটা মামলায় জামিন হয়েছে। এখন দুইটা মামলা আছে। এই দুটি মামলায় মারধর করে ১৬৪ নিয়েছিল। এখন এই দুইটা মামলাতে জামিন করতে পারতেছি না। অনেক ঝামেলা হচ্ছে। বারবার জামিন না-মঞ্জুর হচ্ছে।
গুম কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলছে, আমরা এমন বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ আবিষ্কার করেছি, যা নির্যাতনের যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত ছিল। ৫ আগস্টের পর এই প্রমাণ ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা কিছু চিহ্ন আবিষ্কার করতে পেরেছি, যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। কক্ষগুলোতে ঘূর্ণায়মান চেয়ার, জম টুপি (মাথা ঢাকার কাপড়) এবং মানুষকে ঝুলিয়ে পেটানোর সরঞ্জাম ছিল। প্রায় প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান ছিল শব্দ নিরোধক, যাতে ভুক্তভোগীদের আর্তনাদ বাইরে না পৌঁছায়। ভুক্তভোগীদের চিৎকারের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে দিতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হতো। গান নির্যাতনকারীদের আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম ছিল।
একজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, আমাকে নির্যাতন করার সময় ওরা উচ্চ শব্দে গান বাজাইত। হিন্দি গান চালিয়ে মারত।
গুম কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে কনসালট্যান্ট ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ড. আনিস আহমেদ গুম হওয়া ব্যক্তিদের এবং তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বৈশ্বিক ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি কমিশনকে বলেন, গুম থেকে ফিরে আসা ভুক্তভোগী এবং এখনও নিখোঁজদের পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব অত্যন্ত জটিল। ফিরে আসা ভুক্তভোগীরা ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার, অ্যানজাইটি ডিজঅর্ডার, জটিল ট্রমা এবং কিছু ক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন। সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা, আবেগজনিত অসাড়তা, খিটখিটে মেজাজ, সহিংস আচরণ এবং অতিরিক্ত সতর্কতা। অনেকেই জনসম্মুখে আসার ক্ষেত্রে ভয় পান। কারণ তারা নজরদারি ও পুনরায় টার্গেট হওয়ার আশঙ্কা করেন। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আবেগশূন্য আচরণ করেন, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। এসব মানসিক প্রতিক্রিয়াকে দুর্বলতার নিদর্শন হিসেবে দেখা উচিত নয়।
গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি একটি উপমার মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি কাউকে একটি উঁচু ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা ধাপে ধাপে শারীরিক পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা দিই। কিন্তু কাউকে যদি ট্রমার মধ্যে ছুড়ে ফেলা হয়, সেই আঘাত আমাদের চোখে দেখা যায় না, তাই আমরা প্রায়শই সেটিকে উপেক্ষা করি বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করি।
গুম কমিশন বলছে, ট্রমার বাইরেও গুমের প্রথা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা এবং নির্যাতনকে উৎসাহিত করে এমন একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। নির্যাতনের এই পদ্ধতিগত ও ব্যাপক কর্মকা- ইঙ্গিত দেয় যে, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।